কম্পিউটারের পাওয়ার বাটন চাপার পর থেকে অপারেটিং সিস্টেম চালু হওয়া পর্যন্ত পর্দার আড়ালে অনেক কিছু ঘটে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে বলা হয়
"বুটিং"। আর এই বুটিং প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে যে সফটওয়্যার, তাকে বলা হয় ফার্মওয়্যার
(Firmware)। যুগ যুগ ধরে এই ফার্মওয়্যারের জগতে দুটি প্রধান প্রযুক্তি রাজত্ব করেছে: পুরনো এবং বিশ্বস্ত Legacy
BIOS এবং আধুনিক ও শক্তিশালী UEFI।
আপনি যদি নতুন কম্পিউটার কিনতে যান বা পুরনো কম্পিউটার আপগ্রেড করার কথা ভাবেন, তাহলে এই দুটি নামের সম্মুখীন হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনটি ভালো? কেনই বা একটির বদলে অন্যটি ব্যবহার করা হচ্ছে?
আজকের এই বিস্তারিত টিউটোরিয়ালে আমরা এই দুটি বুট প্রযুক্তির যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করব। চলুন, সহজ ভাষায় জেনে নেওয়া যাক
Legacy BIOS এবং UEFI-এর পার্থক্য, সুবিধা-অসুবিধা এবং ভবিষ্যতের কথা।
Legacy
BIOS কি? (What is Legacy BIOS?)
BIOS-এর পুরো নাম হলো Basic Input/Output System। এটি ১৯৮০-এর দশক থেকে কম্পিউটারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি মূলত মাদারবোর্ডের একটি ছোট চিপে সংরক্ষিত একটি সফটওয়্যার, যা কম্পিউটার চালু হওয়ার সাথে সাথে হার্ডওয়্যারগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে (এই প্রক্রিয়াকে POST বা Power-On
Self-Test বলা হয়) এবং তারপর হার্ডডিস্ক থেকে অপারেটিং সিস্টেমকে খুঁজে বের করে র্যামে লোড করে দেয়।
Legacy
BIOS-এর সীমাবদ্ধতা:
এত বছর ধরে সেবা দিয়ে এলেও আধুনিক কম্পিউটারের জন্য BIOS এখন অনেকটাই সেকেলে। এর কিছু বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে:
- ডিস্ক সাইজের সীমাবদ্ধতা: BIOS শুধুমাত্র MBR
(Master Boot Record) পার্টিশন স্টাইল ব্যবহার করতে পারে। MBR পার্টিশন স্কিম সর্বোচ্চ ২.২ টেরাবাইট (TB) পর্যন্ত হার্ডডিস্ক সাপোর্ট করে। আজকের দিনে যেখানে ৪-৮ টেরাবাইটের হার্ডডিস্ক খুব সাধারণ, সেখানে এটি একটি বিশাল সীমাবদ্ধতা।
- পার্টিশন সংখ্যা: MBR ব্যবহার করে আপনি একটি ডিস্কে সর্বোচ্চ ৪টি প্রাইমারি পার্টিশন তৈরি করতে পারবেন।
- বুট স্পীড: BIOS-এর বুটিং প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে ধীর। এটি একবারে একটি করে হার্ডওয়্যার পরীক্ষা করে, যা সময়সাপেক্ষ।
- ইন্টারফেস: এর ইন্টারফেস সম্পূর্ণরূপে টেক্সট-ভিত্তিক এবং দেখতে পুরনো দিনের মতো। এখানে মাউস ব্যবহার করা যায় না, শুধুমাত্র কিবোর্ড দিয়ে কাজ করতে হয়।
- সিকিউরিটি: Legacy
BIOS-এ আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। ফলে বুটকিট (Bootkit) নামক ম্যালওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, যা অপারেটিং সিস্টেম চালু হওয়ার আগেই কম্পিউটারকে সংক্রামিত করতে পারে।
UEFI কি?
(What is UEFI?)
UEFI-এর পুরো নাম হলো Unified Extensible Firmware Interface। এটি BIOS-এর আধুনিক বিকল্প এবং একটি উন্নত প্রযুক্তি। একে আপনি একটি ছোটখাটো অপারেটিং সিস্টেমের সাথে তুলনা করতে পারেন যা আপনার কম্পিউটারের মূল অপারেটিং সিস্টেম চালু হওয়ার আগে কাজ করে।
UEFI তৈরিই করা হয়েছে BIOS-এর সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার জন্য।
UEFI-এর প্রধান সুবিধা:
- বড় হার্ডডিস্ক সাপোর্ট: UEFI ব্যবহার করে GPT
(GUID Partition Table) পার্টিশন স্টাইল। GPT ব্যবহার করে আপনি কার্যত সীমাহীন আকারের (থিওরি অনুযায়ী ৯.৪ জেট্টাবাইট পর্যন্ত) হার্ডডিস্ক ব্যবহার করতে পারবেন।
- পার্টিশন সংখ্যা: GPT পার্টিশন স্কিমে আপনি একটি ডিস্কে সর্বোচ্চ ১২৮টি প্রাইমারি পার্টিশন তৈরি করতে পারবেন।
- দ্রুত বুটিং: UEFI সমান্তরালভাবে একাধিক হার্ডওয়্যার পরীক্ষা করতে পারে এবং হার্ডওয়্যার ইনিশিয়ালাইজেশন প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত সম্পন্ন করে। ফলে কম্পিউটার চালু হয় চোখের পলকে।
- আধুনিক ইন্টারফেস: UEFI ফার্মওয়্যারের ইন্টারফেস গ্রাফিক্যাল (GUI) এবং এতে মাউস ব্যবহার করা যায়। এটি দেখতে অনেক সুন্দর এবং ব্যবহার করাও খুব সহজ।
- উন্নত নিরাপত্তা: UEFI-এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো "Secure Boot" ফিচার। এটি একটি ডিজিটাল গার্ডের মতো কাজ করে, যা নিশ্চিত করে যে কম্পিউটার চালু হওয়ার সময় শুধুমাত্র বিশ্বস্ত এবং ডিজিটালভাবে স্বাক্ষরিত সফটওয়্যার (যেমন আপনার উইন্ডোজ বা লিনাক্স) লোড হবে। এটি ক্ষতিকর বুটকিট ম্যালওয়্যারকে সহজেই প্রতিহত করে।
- নেটওয়ার্কিং ফিচার: UEFI ফার্মওয়্যার থেকে সরাসরি নেটওয়ার্কিং এবং রিমোট ডায়াগনস্টিকসের মতো কাজ করা সম্ভব, যা BIOS-এ কল্পনাও করা যেত না।
Legacy
BIOS বনাম UEFI: মূল পার্থক্যগুলো একনজরে
আসুন একটি টেবিলের মাধ্যমে পার্থক্যগুলো আরও পরিষ্কারভাবে বুঝে নিই।
বৈশিষ্ট্য (Feature) |
Legacy BIOS |
UEFI |
আবিষ্কারের সময় |
১৯৮০-এর দশক |
২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি |
ইন্টারফেস |
টেক্সট-ভিত্তিক (কিবোর্ড নির্ভর) |
গ্রাফিক্যাল (মাউস সাপোর্ট করে) |
পার্টিশন স্টাইল |
MBR (Master Boot
Record) |
GPT (GUID
Partition Table) |
সর্বোচ্চ ডিস্ক সাইজ |
২.২ টেরাবাইট (TB) |
৯.৪ জেট্টাবাইট (Zettabyte) |
সর্বোচ্চ পার্টিশন সংখ্যা |
৪টি প্রাইমারি পার্টিশন |
১২৮টি পার্টিশন |
বুট স্পীড |
ধীরগতির |
অত্যন্ত দ্রুত |
সিকিউরিটি |
মৌলিক, কোনো Secure Boot নেই |
উন্নত, Secure Boot ফিচারযুক্ত |
প্রসেসর মোড |
১৬-বিট |
৩২-বিট বা ৬৪-বিট |
কেন UEFI এখন স্ট্যান্ডার্ড?
উপরের পার্থক্যগুলো দেখলেই বোঝা যায়, UEFI
প্রায় সব দিক থেকেই Legacy BIOS-এর চেয়ে উন্নত। আধুনিক কম্পিউটিং-এর চাহিদা মেটাতে UEFI অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
- বড় স্টোরেজ: আজকাল ২ টেরাবাইটের চেয়ে বড় হার্ডডিস্ক বা SSD খুবই সাধারণ। শুধুমাত্র UEFI-ই এই বড় ড্রাইভগুলো সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারে।
- গতি: ব্যবহারকারীরা এখন দ্রুতগতির সিস্টেম পছন্দ করেন। UEFI-এর ফাস্ট বুট ফিচার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কম্পিউটার চালু করে দেয়।
- নিরাপত্তা: সাইবার অ্যাটাক এবং ম্যালওয়্যারের যুগে Secure Boot একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফিচার, যা আপনার সিস্টেমকে বুট-লেভেল ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে।
- সহজ ব্যবহার: গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস থাকায় নতুন ব্যবহারকারীদের জন্যেও ফার্মওয়্যার সেটিংস পরিবর্তন করা অনেক সহজ হয়ে গেছে।
আপনার কম্পিউটারে কোনটি আছে? কিভাবে চেক করবেন?
আপনার কম্পিউটারে Legacy BIOS নাকি UEFI মোড চলছে, তা জানা খুবই সহজ। নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন:
- আপনার কিবোর্ড থেকে Windows
Key + R একসাথে চাপুন। এতে Run ডায়ালগ বক্স খুলবে।
- এবার টাইপ করুন msinfo32 এবং Enter চাপুন বা OK-তে ক্লিক করুন।
- এতে System
Information উইন্ডো খুলবে।
- বাম পাশের প্যানেল থেকে System
Summary সিলেক্ট করা আছে কিনা নিশ্চিত করুন।
- ডান পাশে আইটেমগুলোর লিস্টে "BIOS
Mode" নামে একটি অপশন খুঁজুন।
- যদি এর পাশে "UEFI" লেখা থাকে, তাহলে আপনার সিস্টেম UEFI মোডে চলছে।
- যদি এর পাশে "Legacy" লেখা থাকে, তাহলে আপনার সিস্টেম পুরনো BIOS মোডে চলছে।
ভবিষ্যৎ কী?
কম্পিউটার প্রযুক্তির এই যুদ্ধে UEFI নিঃসন্দেহে বিজয়ী।
Legacy BIOS এখন একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রযুক্তি।
Intel-এর মতো বড় বড় চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন মাদারবোর্ডে
Legacy BIOS সাপোর্ট দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে।
শেষ কথা হলো, ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণভাবেই UEFI-এর দখলে। আপনি যদি একটি নতুন কম্পিউটার কেনেন, তবে নিশ্চিতভাবেই সেটি UEFI ফার্মওয়্যার সহ আসবে। আর যদি পুরনো সিস্টেমে অপারেটিং সিস্টেম ইনস্টল করার সুযোগ থাকে, তাহলে GPT পার্টিশন ব্যবহার করে UEFI মোডে ইনস্টল করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
আশা করি, এই আলোচনার মাধ্যমে
Legacy BIOS এবং UEFI সম্পর্কে আপনার ধারণা পরিষ্কার হয়েছে এবং আপনি এখন থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
জ্ঞান যাচাই (Knowledge Check)
এখন আপনার জ্ঞান পরীক্ষা করার পালা! নিচের ১৫টি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিন।
১. BIOS-এর পূর্ণরূপ কী?
A) Basic Integrated Operating System
B) Basic Input/Output System
C) Booting Input/Output Software
D) Binary Input/Output System
২. UEFI কোন পার্টিশন স্টাইল ব্যবহার করে?
A) MBR
B) NTFS
C) GPT
D) EXT4
৩. Legacy BIOS সর্বোচ্চ কত বড় হার্ডডিস্ক সাপোর্ট করে?
A) ১ টেরাবাইট
B) ২.২ টেরাবাইট
C) ৪ টেরাবাইট
D) সীমাহীন
৪. "Secure Boot" ফিচারটি কোন প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত?
A) Legacy BIOS
B) MBR
C) UEFI
D) POST
৫. কোনটি ব্যবহারকারীকে গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস ও মাউস সাপোর্ট প্রদান করে?
A) BIOS
B) DOS
C) UEFI
D) MBR
৬. GPT পার্টিশন স্কিমে সর্বোচ্চ কয়টি পার্টিশন তৈরি করা যায়?
A) ৪টি
B) ৩২টি
C) ৬৪টি
D) ১২৮টি
৭. কম্পিউটার চালু হওয়ার সময় হার্ডওয়্যার পরীক্ষা করার প্রক্রিয়াকে কী বলা হয়?
A) Booting
B) POST (Power-On Self-Test)
C) Loading
D) Scanning
৮. MBR-এর পূর্ণরূপ কী?
A) Main Boot Record
B) Master Boot Record
C) Mega Boot Record
D) Master BIOS Record
৯. কোনটি দ্রুত বুটিং স্পীড প্রদান করে?
A) Legacy BIOS
B) UEFI
C) দুটিই সমান
D) এটি র্যামের উপর নির্ভর করে
১০. উইন্ডোজে BIOS মোড চেক করার জন্য RUN-এ কোন কমান্ডটি টাইপ করতে হয়?
A) cmd
B) control
C) msconfig
D) msinfo32
১১. UEFI-এর পূর্ণরূপ কী?
A) Universal Extensible Firmware Interface
B) Unified Extensible Firmware Interface
C) Unified External Firmware Interaction
D) Universal Boot Firmware Interface
১২. কোন প্রযুক্তিটি বুট-লেভেল ম্যালওয়্যার (বুটকিট) প্রতিরোধে বেশি কার্যকর?
A) Legacy BIOS
B) UEFI (Secure Boot সহ)
C) MBR
D) CMOS
১৩. Legacy BIOS কোন প্রসেসর মোডে কাজ করে?
A) ১৬-বিট
B) ৩২-বিট
C) ৬৪-বিট
D) ৮-বিট
১৪. আধুনিক মাদারবোর্ডগুলোতে কোন ফার্মওয়্যার স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়?
A) Legacy BIOS
B) UEFI
C) উভয়ই সমানভাবে
D) কোনোটিই নয়
১৫. MBR পার্টিশন স্কিমে সর্বোচ্চ কয়টি প্রাইমারি পার্টিশন তৈরি করা যায়?
A) ২টি
B) ৪টি
C) ৮টি
D) ১৬টি
উত্তরমালা:
- B) Basic
Input/Output System
- C) GPT
- B) ২.২ টেরাবাইট
- C) UEFI
- C) UEFI
- D) ১২৮টি
- B) POST
(Power-On Self-Test)
- B) Master Boot
Record
- B) UEFI
- D) msinfo32
- B) Unified
Extensible Firmware Interface
- B) UEFI (Secure
Boot সহ)
- A) ১৬-বিট
- B) UEFI
- B) ৪টি