আপনার শখের বা কাজের কম্পিউটারটি কি আগের মতো দ্রুত কাজ করছে না? সামান্য একটা ফাইল খুলতে বা ব্রাউজার চালু করতে কি মিনিটের পর মিনিট অপেক্ষা করতে হচ্ছে? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে আপনি একা নন। সময়ের সাথে সাথে প্রায় সব উইন্ডোজ কম্পিউটারই ধীর গতির সমস্যায় ভোগে। কিন্তু হতাশ হওয়ার কিছু নেই! এর কারণগুলো খুঁজে বের করে কিছু সহজ পদক্ষেপ নিলেই আপনার পুরোনো কম্পিউটারেও নতুন স্পিড ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এই বিস্তারিত আর্টিকেলে আমরা জানব কেন আপনার কম্পিউটার স্লো হয়ে যায়, কীভাবে পারফরম্যান্স মনিটরিং করে আসল সমস্যা খুঁজে বের করবেন এবং সেই সমস্যা সমাধানের জন্য কী কী কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেন।
কেন আপনার উইন্ডোজ কম্পিউটার স্লো হয়ে যায়? আসল কারণগুলো জানুন
কোনো সমস্যার সমাধান করার আগে তার কারণ জানাটা জরুরি। আপনার কম্পিউটারের গতি কমে যাওয়ার পেছনে এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে। চলুন প্রধান কারণগুলো জেনে নেওয়া যাক:
- অতিরিক্ত স্টার্টআপ প্রোগ্রাম (Too many
Startup Programs): কম্পিউটার চালু হওয়ার সাথে সাথে অনেকগুলো প্রোগ্রাম ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে শুরু করে। এই প্রোগ্রামগুলো আপনার সিস্টেমের র্যাম (RAM) এবং প্রসেসর (CPU) ব্যবহার করে, ফলে কম্পিউটার চালু হতেও বেশি সময় নেয় এবং সার্বিক পারফরম্যান্স কমে যায়।
- রিসোর্স-খেকো সফটওয়্যার
(Resource-hungry Software): কিছু সফটওয়্যার, যেমন - ভিডিও এডিটিং টুলস, গ্রাফিক্স ডিজাইন সফটওয়্যার বা আধুনিক গেমগুলো প্রচুর পরিমাণে সিস্টেম রিসোর্স (র্যাম, সিপিইউ, ডিস্ক) ব্যবহার করে। এগুলো চালু থাকলে অন্যান্য কাজ ধীর হয়ে যায়।
- হার্ড ড্রাইভে অপর্যাপ্ত জায়গা (Insufficient
Hard Drive Space): আপনার অপারেটিং সিস্টেম যে ড্রাইভে (সাধারণত C: ড্রাইভ) ইনস্টল করা আছে, সেখানে পর্যাপ্ত খালি জায়গা না থাকলে উইন্ডোজ ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। সিস্টেম ফাইল, টেম্পোরারি ফাইল এবং ভার্চুয়াল মেমোরির জন্য খালি জায়গার প্রয়োজন হয়।
- ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার (Viruses or
Malware): আপনার কম্পিউটারে ভাইরাস, স্পাইওয়্যার বা অন্য কোনো ম্যালওয়্যার প্রবেশ করলে তা গোপনে ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে থাকে এবং আপনার সিস্টেমের গতি মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়। এছাড়া এটি আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
- পুরানো হার্ডওয়্যার (Outdated
Hardware): যদি আপনার কম্পিউটার অনেক পুরোনো হয়, তবে এর হার্ডওয়্যার (যেমন - র্যাম, প্রসেসর, হার্ড ড্রাইভ) আধুনিক সফটওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেমের চাহিদা পূরণ করতে পারে না।
- অপ্রয়োজনীয় ফাইল ও টেম্পোরারি ফাইল (Junk and
Temporary Files): ইন্টারনেট ব্রাউজিং, সফটওয়্যার ইনস্টলেশন এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে কম্পিউটারে প্রচুর অপ্রয়োজনীয় বা টেম্পোরারি ফাইল জমা হয়। এই ফাইলগুলো হার্ড ড্রাইভের জায়গা নষ্ট করে এবং সিস্টেমকে স্লো করে দেয়।
- অনেক বেশি ব্রাউজার ট্যাব ও এক্সটেনশন: একসাথে ব্রাউজারে অনেকগুলো ট্যাব খুলে রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় এক্সটেনশন ব্যবহার করা আপনার র্যামের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে, যা পিসির গতি কমিয়ে দেয়।
- উইন্ডোজ ও ড্রাইভার আপডেট না করা: মাইক্রোসফট নিয়মিত উইন্ডোজের জন্য আপডেট প্রকাশ করে, যার মধ্যে পারফরম্যান্স উন্নতি এবং নিরাপত্তা প্যাচ থাকে। এই আপডেটগুলো ইনস্টল না করলে আপনার কম্পিউটার স্লো এবং ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
পারফরম্যান্স মনিটরিং: সমস্যার উৎস খুঁজে বের করুন
কম্পিউটারের গতি বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার আগে আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করা জরুরি। আর এর জন্য উইন্ডোজের বিল্ট-ইন টাস্ক ম্যানেজার (Task
Manager) হলো আপনার সেরা বন্ধু।
কীভাবে টাস্ক ম্যানেজার খুলবেন?
কিবোর্ড থেকে Ctrl +
Shift + Esc একসাথে চাপুন। অথবা টাস্কবারে রাইট-ক্লিক করে
"Task Manager" সিলেক্ট করুন।
টাস্ক ম্যানেজারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ট্যাব রয়েছে:
- Processes (প্রসেস) ট্যাব: এখানে আপনি দেখতে পারবেন কোন কোন অ্যাপ বা প্রোগ্রাম বর্তমানে চলছে এবং সেগুলো কী পরিমাণ CPU, Memory
(RAM), Disk এবং Network ব্যবহার করছে। যদি দেখেন কোনো নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি রিসোর্স ব্যবহার করছে, তবে আপনি সমস্যার উৎস খুঁজে পেয়েছেন।
- Performance (পারফরম্যান্স) ট্যাব: এই ট্যাবে আপনি রিয়েল-টাইমে আপনার CPU, মেমোরি (র্যাম), ডিস্ক (HDD/SSD) এবং নেটওয়ার্ক ব্যবহারের একটি লাইভ গ্রাফ দেখতে পাবেন। যদি দেখেন কোনো একটি রিসোর্স sürekli ৯০-১০০% ব্যবহৃত হচ্ছে, তবে বুঝতে হবে সেখানেই সমস্যা।
- Startup (স্টার্টআপ) ট্যাব: এখানে সেই সব প্রোগ্রামের তালিকা থাকে যেগুলো কম্পিউটার চালু হওয়ার সাথে সাথে অটোমেটিক্যালি রান হয়। প্রতিটি প্রোগ্রামের পাশে এর "Startup
Impact" (High, Medium, Low) দেখানো থাকে, যা থেকে বোঝা যায় এটি সিস্টেমের গতি কতটা কমাচ্ছে।
এই টুলটি ব্যবহার করে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন কোন সফটওয়্যার বা প্রসেস আপনার কম্পিউটারকে ধীর করে দিচ্ছে।
উইন্ডোজ কম্পিউটারের গতি বাড়ানোর ১০টি কার্যকরী উপায়
সমস্যার কারণ যখন জানা হয়ে গেছে, তখন সমাধানের পালা। নিচের পদক্ষেপগুলো এক এক করে অনুসরণ করুন আর দেখুন আপনার কম্পিউটারের স্পিড কীভাবে বেড়ে যায়!
১. স্টার্টআপ প্রোগ্রাম ম্যানেজ করুন
টাস্ক ম্যানেজারের Startup ট্যাবে যান। যে প্রোগ্রামগুলো কম্পিউটার চালুর সময় অটোমেটিক রান হওয়ার প্রয়োজন নেই (যেমন -
Spotify, Skype, uTorrent), সেগুলোর উপর রাইট-ক্লিক করে "Disable" করে দিন। এতে আপনার কম্পিউটার দ্রুত চালু হবে এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে র্যাম খরচ কম হবে।
২. অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যার আনইনস্টল করুন
সময়ের সাথে সাথে আমরা অনেক সফটওয়্যার ইনস্টল করি যা পরে আর ব্যবহার করা হয় না। এই সফটওয়্যারগুলো হার্ড ড্রাইভের জায়গা দখল করে এবং সিস্টেমকে ভারী করে তোলে।
- Control Panel > Programs
and Features এ যান।
- তালিকা থেকে অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যারগুলো খুঁজে বের করুন এবং একটি একটি করে "Uninstall" করুন।
৩. ডিস্ক ক্লিনআপ ও ডিফ্র্যাগমেন্ট করুন
অপ্রয়োজনীয় ফাইল মুছে ফেলে হার্ড ড্রাইভকে গুছিয়ে নিলে পারফরম্যান্স লক্ষণীয়ভাবে বাড়ে।
- ডিস্ক ক্লিনআপ (Disk
Cleanup):
- Start মেনুতে "Disk
Cleanup" লিখে সার্চ করুন এবং অ্যাপটি খুলুন।
- আপনার C: ড্রাইভ সিলেক্ট করে OK চাপুন।
- সিস্টেম কিছু সময় স্ক্যান করার পর একটি তালিকা দেখাবে। Temporary
files, Recycle Bin, Thumbnails ইত্যাদি সিলেক্ট করে OK চাপুন।
- ডিফ্র্যাগমেন্ট (Defragment
and Optimize Drives):
- (শুধুমাত্র HDD ব্যবহারকারীদের জন্য) হার্ড ড্রাইভে ফাইলগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। ডিফ্র্যাগমেন্ট করলে এই ফাইলগুলো গুছিয়ে আনা হয়, ফলে ফাইল অ্যাক্সেস দ্রুত হয়।
- Start মেনুতে
"Defragment" লিখে সার্চ করুন এবং
"Defragment and Optimize Drives" টুলটি খুলুন।
- আপনার ড্রাইভ সিলেক্ট করে "Optimize" বাটনে ক্লিক করুন।
- (আপনি যদি SSD ব্যবহার করেন, তবে ডিফ্র্যাগমেন্ট করার প্রয়োজন নেই। উইন্ডোজ নিজে থেকেই একে Optimize
(TRIM) করে।)
৪. ভাইরাস ও ম্যালওয়্যার স্ক্যান করুন
ভাইরাস আপনার পিসি স্লো হওয়ার একটি বড় কারণ হতে পারে। উইন্ডোজের বিল্ট-ইন Windows
Security (বা Windows Defender) ব্যবহার করে একটি ফুল সিস্টেম স্ক্যান চালান।
- Settings >
Update & Security > Windows Security > Virus & threat
protection এ যান।
- "Scan
options" থেকে "Full scan" সিলেক্ট করে "Scan
now" ক্লিক করুন।
৫. উইন্ডোজ ও ড্রাইভার আপডেট রাখুন
নিশ্চিত করুন আপনার উইন্ডোজ আপ-টু-ডেট আছে।
- Settings >
Update & Security > Windows Update এ গিয়ে "Check
for updates" ক্লিক করুন।
- একইসাথে আপনার গ্রাফিক্স কার্ড, সাউন্ড কার্ড এবং অন্যান্য হার্ডওয়্যারের ড্রাইভারগুলোও প্রস্তুতকারকের ওয়েবসাইট থেকে আপডেট করুন।
৬. পাওয়ার প্ল্যান পরিবর্তন করুন
ল্যাপটপ ব্যবহারকারীরা প্রায়ই ব্যাটারি বাঁচানোর জন্য
"Balanced" বা "Power saver" মোডে কম্পিউটার ব্যবহার করেন, যা পারফরম্যান্স কমিয়ে দেয়।
- Control Panel
> Hardware and Sound > Power Options এ যান।
- এখান থেকে "High
performance" প্ল্যানটি সিলেক্ট করুন। এটি বেশি পাওয়ার ব্যবহার করবে কিন্তু আপনার পিসিকে সর্বোচ্চ গতিতে চলতে সাহায্য করবে।
৭. ভিজ্যুয়াল এফেক্টস কমান
উইন্ডোজের সুন্দর অ্যানিমেশন এবং শ্যাডো ইফেক্টগুলো দেখতে ভালো লাগলেও এগুলো সিস্টেমের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
- File Explorer এ "This
PC" এর উপর রাইট-ক্লিক করে "Properties" এ যান।
- ডান পাশ থেকে "Advanced
system settings" এ ক্লিক করুন।
- Performance সেকশনের অধীনে "Settings" বাটনে ক্লিক করুন।
- "Adjust
for best performance" অপশনটি সিলেক্ট করুন অথবা নিজের পছন্দমতো অপ্রয়োজনীয় ইফেক্টগুলো আনচেক করে দিন।
৮. র্যাম
(RAM) আপগ্রেড বিবেচনা করুন
যদি আপনি একসাথে অনেকগুলো প্রোগ্রাম বা ব্রাউজার ট্যাব ব্যবহার করেন এবং টাস্ক ম্যানেজারে দেখেন আপনার র্যামের ব্যবহার প্রায় সবসময়ই ১০০%-এর কাছাকাছি থাকছে, তবে র্যাম আপগ্রেড করার কথা ভাবতে পারেন। ৮ জিবি র্যাম বর্তমান সময়ের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড মান, তবে ভারী কাজের জন্য ১৬ জিবি বা তার বেশি র্যাম পারফরম্যান্সে বিশাল পার্থক্য গড়ে দেবে।
৯. হার্ড ড্রাইভ থেকে
SSD-তে আপগ্রেড করুন
আপনার কম্পিউটারের গতি বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো পুরোনো মেকানিক্যাল হার্ড ড্রাইভ (HDD)
বদলে নতুন সলিড-স্টেট ড্রাইভ (SSD) ব্যবহার করা। HDD-এর তুলনায় SSD দশ গুণেরও বেশি দ্রুত ডেটা রিড ও রাইট করতে পারে। SSD লাগানোর পর আপনি দেখবেন আপনার কম্পিউটার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চালু হচ্ছে এবং সফটওয়্যারগুলো প্রায় সাথে সাথেই খুলছে।
১০. ব্রাউজার পরিষ্কার রাখুন
- একসাথে অতিরিক্ত ট্যাব খোলা থেকে বিরত থাকুন।
- ব্রাউজারের সেটিংস থেকে অপ্রয়োজনীয় এক্সটেনশনগুলো Disable বা Remove করুন।
- মাঝে মাঝে ব্রাউজারের ক্যাশ (Cache) ও কুকিজ (Cookies) ক্লিয়ার করুন।
উপসংহার
কম্পিউটার স্লো হয়ে যাওয়া একটি সাধারণ সমস্যা, কিন্তু এর সমাধান আপনার হাতেই রয়েছে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং এই আর্টিকেলে বর্ণিত কৌশলগুলো প্রয়োগ করলে আপনি খুব সহজেই আপনার ধীর গতির উইন্ডোজ কম্পিউটারকে पुन्हा দ্রুতগামী করে তুলতে পারবেন। মনে রাখবেন, পারফরম্যান্স মনিটরিং হলো প্রথম ধাপ এবং এরপর সঠিক পদক্ষেপ নিলেই আপনি পাবেন একটি মসৃণ ও দ্রুত কম্পিউটিং অভিজ্ঞতা।