আজকের ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট ছাড়া
জীবন কল্পনা করা কঠিন। শহর অঞ্চলে ফাইবার অপটিক বা ব্রডব্যান্ড সংযোগ সহজলভ্য হলেও, বিশ্বের অনেক প্রত্যন্ত ও
দুর্গম এলাকায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট এখনও স্বপ্নের মতো। এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে
এসেছে ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্স (SpaceX) তাদের যুগান্তকারী প্রকল্প
"স্টারলিঙ্ক" (Starlink)
নিয়ে। স্টারলিঙ্ক হলো স্যাটেলাইটের
মাধ্যমে মহাকাশ থেকে সরাসরি পৃথিবীতে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার এক উচ্চাভিলাষী
পরিকল্পনা।
কিন্তু
প্রশ্ন হলো, মহাকাশে
থাকা শত শত স্যাটেলাইট কিভাবে আমাদের ঘরে বা অফিসে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়? চলুন, স্টারলিঙ্কের পেছনের প্রযুক্তি
এবং এর কার্যপ্রণালী বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।
স্টারলিঙ্ক কি? (What is Starlink?)
স্টারলিঙ্ক
হলো স্পেসএক্স দ্বারা পরিচালিত একটি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কনস্টেলেশন (Constellation) বা স্যাটেলাইটের ঝাঁক। এর মূল
লক্ষ্য হলো পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে (Low Earth
Orbit - LEO) হাজার হাজার ছোট ছোট স্যাটেলাইট
স্থাপন করে সারা বিশ্বে, বিশেষ
করে যেখানে প্রচলিত ইন্টারনেট অবকাঠামো নেই বা দুর্বল, সেখানে উচ্চ গতির এবং কম
লেটেন্সির (Low Latency) ইন্টারনেট
সেবা প্রদান করা।
প্রচলিত স্যাটেলাইট
ইন্টারনেট থেকে স্টারলিঙ্ক কোথায় আলাদা?
আগেও
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ছিল, কিন্তু
সেগুলো সাধারণত জিওস্টেশনারি বা ভূ-সমলয় কক্ষপথে (Geostationary Orbit - GEO) থাকা
বিশাল স্যাটেলাইট ব্যবহার করত। এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৫,৭৮৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থান
করে। এত দূরত্বের কারণে সিগন্যাল যেতে এবং আসতে অনেক বেশি সময় লাগত, যার ফলে লেটেন্সি (ডেটা পাঠানো
ও গ্রহণ করার মধ্যবর্তী সময়) অনেক বেশি হতো। এটি ভিডিও কল, অনলাইন গেমিং বা রিয়েল-টাইম
কাজের জন্য উপযুক্ত ছিল না।
অন্যদিকে, স্টারলিঙ্কের স্যাটেলাইটগুলো
পৃথিবীর অনেক কাছাকাছি, মাত্র
৫৫০ কিলোমিটারের মতো উচ্চতায় (LEO) অবস্থান করে।
এই কম দূরত্বের কারণে সিগন্যাল দ্রুত আসা-যাওয়া করতে পারে, ফলে লেটেন্সি নাটকীয়ভাবে কমে
যায় (সাধারণত ২০-৪০ মিলিসেকেন্ড), যা
ফাইবার অপটিক ইন্টারনেটের কাছাকাছি।
স্টারলিঙ্ক কিভাবে
কাজ করে? (How
does Starlink Work?)
স্টারলিঙ্কের
কার্যপ্রণালী কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:
১. স্যাটেলাইটের বিশাল
নেটওয়ার্ক (Satellite
Constellation): স্টারলিঙ্ক
হাজার হাজার ছোট, অত্যাধুনিক
স্যাটেলাইট ব্যবহার করে যা পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে একটি জালের মতো বিন্যস্ত থাকে।
এই স্যাটেলাইটগুলো একে অপরের সাথে এবং পৃথিবীর গ্রাউন্ড স্টেশনগুলোর সাথে লেজার বা
রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে।
২. ব্যবহারকারীর
টার্মিনাল (User
Terminal): গ্রাহকদের
একটি ছোট ডিশ অ্যান্টেনা (যাকে "ডিশি ম্যাকফ্ল্যাটফেস" বলা হয়) এবং একটি
ওয়াইফাই রাউটার দেওয়া হয়। এই ডিশটি আকাশের দিকে মুখ করে স্যাটেলাইট থেকে সিগন্যাল
গ্রহণ ও প্রেরণ করে। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আকাশের সবচেয়ে উপযুক্ত স্যাটেলাইটের দিকে
নিজেকে নির্দেশিত করতে পারে।
৩. গ্রাউন্ড স্টেশন (Ground Stations): পৃথিবীজুড়ে
বিভিন্ন স্থানে স্পেসএক্স গ্রাউন্ড স্টেশন বা গেটওয়ে স্থাপন করেছে। এই স্টেশনগুলো
ফাইবার অপটিক কেবলের মাধ্যমে মূল ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত।
৪. তথ্যের আদান-প্রদান
(Data Transmission):
* যখন আপনি
ইন্টারনেট ব্যবহার করেন (যেমন একটি ওয়েবসাইট খোলেন), আপনার অনুরোধটি ডিশ অ্যান্টেনার
মাধ্যমে নিকটতম স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইটে পাঠানো হয়।
* স্যাটেলাইট
সেই অনুরোধটি লেজার বা রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে অন্য স্যাটেলাইটে অথবা সরাসরি
নিকটবর্তী গ্রাউন্ড স্টেশনে পাঠায়।
* গ্রাউন্ড
স্টেশন সেই অনুরোধটি ইন্টারনেটে প্রেরণ করে এবং ওয়েবসাইট থেকে ডেটা গ্রহণ করে।
* প্রাপ্ত
ডেটা আবার গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটে পাঠানো হয়।
* অবশেষে, স্যাটেলাইট সেই ডেটা আপনার ডিশ
অ্যান্টেনার মাধ্যমে আপনার ডিভাইসে পৌঁছে দেয়।
এই পুরো
প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দ্রুত সম্পন্ন হয়, যার ফলে ব্যবহারকারীরা উচ্চ
গতির ইন্টারনেট এবং কম লেটেন্সি উপভোগ করতে পারেন।
স্টারলিঙ্ক
ব্যবহারের সুবিধা (Advantages
of Starlink):
·
প্রত্যন্ত অঞ্চলে
সংযোগ: যেখানে
ফাইবার অপটিক বা মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছায়নি, সেখানেও ইন্টারনেট সেবা পাওয়া
সম্ভব।
·
উচ্চ গতি: স্টারলিঙ্ক
সাধারণত ৫০ Mbps থেকে ২০০
Mbps পর্যন্ত
ডাউনলোড স্পিড প্রদান করে, যা অনেক
ব্রডব্যান্ড সংযোগের সাথে তুলনীয় বা তার চেয়েও ভালো।
·
কম লেটেন্সি: LEO স্যাটেলাইট
ব্যবহারের কারণে লেটেন্সি অনেক কম, যা
অনলাইন গেমিং, ভিডিও
কনফারেন্সিং এবং অন্যান্য রিয়েল-টাইম অ্যাপ্লিকেশনের জন্য চমৎকার।
·
তুলনামূলক সহজ
ইনস্টলেশন: ব্যবহারকারী
নিজেই কিটটি ইনস্টল করতে পারেন, যদিও
পরিষ্কার আকাশ এবং সঠিক দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।
স্টারলিঙ্ক
ব্যবহারের অসুবিধা বা চ্যালেঞ্জ (Disadvantages/Challenges):
·
খরচ: হার্ডওয়্যার
(ডিশ ও রাউটার) কেনার প্রাথমিক খরচ এবং মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি অনেকের জন্য বেশি
হতে পারে।
·
বাধা (Obstructions): ডিশ এবং
স্যাটেলাইটের মধ্যে সরাসরি লাইন-অফ-সাইট (Line-of-sight) প্রয়োজন। গাছপালা, উঁচু ভবন বা অন্য কোনো বাধা
সিগন্যালের মান কমিয়ে দিতে পারে বা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে।
·
আবহাওয়ার প্রভাব: ভারী
বৃষ্টি, তুষারপাত
বা ঘন মেঘ অনেক সময় সিগন্যালের গুণমানকে প্রভাবিত করতে পারে।
·
ধারণক্ষমতা (Capacity): একটি
নির্দিষ্ট এলাকায় ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুব বেশি হয়ে গেলে ইন্টারনেটের গতি কিছুটা
কমতে পারে (কনজেশন)।
·
পরিবেশগত উদ্বেগ: হাজার
হাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে আবর্জনা (Space
Debris) তৈরি করতে পারে এবং রাতের আকাশে
আলো দূষণ (Light Pollution) জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের
গবেষণায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলে উদ্বেগ রয়েছে।
বাংলাদেশে
স্টারলিঙ্ক (Starlink
in Bangladesh):
স্টারলিঙ্ক
বিশ্বব্যাপী তাদের সেবা সম্প্রসারণ করছে। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্টারলিঙ্ক
চালু করার বিষয়ে আলোচনা চলছে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। যদি
এটি চালু হয়, তবে
দেশের প্রত্যন্ত ও ইন্টারনেট সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি একটি
যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে।
শেষ কথা:
স্টারলিঙ্ক
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নিঃসন্দেহে একটি বিপ্লবী প্রযুক্তি। এটি মহাকাশ থেকে
ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানের মাধ্যমে ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর এবং বিশ্বব্যাপী মানুষকে
সংযুক্ত করার অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যদিও এর কিছু চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা
রয়েছে, প্রযুক্তির
উন্নয়ন এবং আরও বেশি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সাথে সাথে স্টারলিঙ্ক ভবিষ্যতে আরও
নির্ভরযোগ্য এবং সহজলভ্য হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। মহাকাশ থেকে ইন্টারনেট পাওয়ার
ধারণা যা একসময় কল্পবিজ্ঞান মনে হতো, স্টারলিঙ্ক
তাকে বাস্তবে পরিণত করেছে।