শিক্ষা
ব্যবস্থা ক্রমাগত উন্নত ও পরিবর্তিত হচ্ছে, যেখানে দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা (Competency-Based
Education - CBE) একটি
আধুনিক ও ফলপ্রসূ পদ্ধতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি একটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক
পদ্ধতি যা শেখার গতির পরিবর্তে জ্ঞান, দক্ষতা ও দক্ষতার প্রয়োগের উপর জোর দেয়। এই
নিবন্ধে আমরা দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা কী, এর বৈশিষ্ট্য, সুবিধা, প্রয়োগের কৌশল এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে
এর গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা (CBE) কী?
দক্ষতা-ভিত্তিক
শিক্ষা (Competency-Based
Education) হল একটি
শিক্ষাদান পদ্ধতি যেখানে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন ও প্রদর্শনের উপর
ফোকাস করা হয়। এটি ঐতিহ্যবাহী গ্রেড-ভিত্তিক শিক্ষার বিপরীত, যেখানে সময়সীমা নির্ধারিত থাকে
এবং সব শিক্ষার্থী একই গতিতে অগ্রসর হয়।
দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষার সংজ্ঞা
CBE
হল এমন
একটি শিক্ষা মডেল যেখানে:
- শিক্ষার্থীদের
নির্দিষ্ট শেখার ফলাফল (Learning Outcomes) অর্জন করতে হয়।
- প্রতিটি শিক্ষার্থী
নিজের গতিতে শিখতে পারে।
- মূল্যায়ন হয়
দক্ষতা প্রদর্শনের ভিত্তিতে, নয়তো শুধু পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে।
- শিক্ষার্থীরা বাস্তব
জীবনে প্রাপ্ত জ্ঞান প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়।
দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য
CBE-এর কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য
নিম্নরূপ:
১. শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিখন
এ পদ্ধতিতে
শিক্ষার্থীর শেখার গতি ও শৈলী বিবেচনা করা হয়, যেখানে প্রত্যেকের জন্য ব্যক্তিগতকৃত শিখনের
সুযোগ থাকে।
২. স্পষ্ট শেখার ফলাফল
প্রতিটি
কোর্স বা মডিউলের জন্য স্পষ্ট দক্ষতা ও শেখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, যা শিক্ষার্থীরা অর্জন করবে।
৩. নমনীয় সময়সীমা
শিক্ষার্থীরা
নিজেদের গতিতে দক্ষতা অর্জন করতে পারে, ফলে দ্রুত বা ধীরে শিখতে পারে।
৪. বাস্তব-জীবনের প্রয়োগ
শিক্ষার্থীরা
শুধু তত্ত্বীয় জ্ঞান নয়,
বাস্তব
সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করে।
৫. ধারাবাহিক মূল্যায়ন
এখানে
মূল্যায়ন হয় দক্ষতা অর্জনের ভিত্তিতে, নয়তো শুধু বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের উপর।
দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
CBE
আধুনিক
শিক্ষার একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্র ও জীবনমুখী শিক্ষার
জন্য। এর গুরুত্ব নিম্নরূপ:
১. কর্মক্ষেত্রে প্রস্তুতি
CBE
শিক্ষার্থীদের
বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দক্ষতা দেয়, যা চাকরির বাজারে তাদের বেশি প্রতিযোগিতামূলক
করে তোলে।
২. ব্যক্তিগতকৃত শিক্ষা
প্রতিটি
শিক্ষার্থীর শেখার ধরন আলাদা। CBE তাদের নিজস্ব গতিতে শিখতে সাহায্য করে, যা ঐতিহ্যবাহী শ্রেণিকক্ষের তুলনায় বেশি
কার্যকর।
৩. দক্ষতা ভিত্তিক মূল্যায়ন
শিক্ষার্থীরা
শুধু মুখস্থবিদ্যা নয়,
বরং দক্ষতা
প্রদর্শনের মাধ্যমে মূল্যায়িত হয়, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য নিশ্চিত করে।
৪. শিক্ষার সমতা নিশ্চিত করা
CBE
দুর্বল ও
মেধাবী সকল শিক্ষার্থীকে সমান সুযোগ দেয়, কারণ প্রত্যেকে নিজের গতিতে দক্ষতা অর্জন
করতে পারে।
৫. জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ
এটি শুধু
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়,
বরং
পেশাদার ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে সাহায্য করে।
দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা বনাম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা
বিষয় |
দক্ষতা-ভিত্তিক
শিক্ষা (CBE) |
ঐতিহ্যবাহী
শিক্ষা |
ফোকাস |
দক্ষতা অর্জন ও প্রয়োগ |
গ্রেড ও পরীক্ষার ফলাফল |
শেখার গতি |
শিক্ষার্থীর নিজস্ব গতি |
নির্দিষ্ট সময়সীমা |
মূল্যায়ন পদ্ধতি |
দক্ষতা প্রদর্শনের উপর ভিত্তি
করে |
পরীক্ষার নম্বরের উপর ভিত্তি
করে |
শিক্ষার্থীর ভূমিকা |
সক্রিয় ও স্বাধীন শিখন |
শিক্ষকের নির্দেশনায় শিখন |
বাস্তব প্রয়োগ |
বেশি ব্যবহারিক ও জীবনমুখী |
তত্ত্বীয় জ্ঞানের উপর জোর |
দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের কৌশল
CBE
সফলভাবে
প্রয়োগ করতে নিচের পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করা যেতে পারে:
১. স্পষ্ট শেখার লক্ষ্য নির্ধারণ
প্রতিটি
কোর্সের জন্য দক্ষতা ভিত্তিক ফলাফল (Competency Outcomes) স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে।
২. নমনীয় শিক্ষার পরিবেশ তৈরি
শিক্ষার্থীদের
নিজস্ব গতিতে শিখতে সুযোগ দিতে হবে, অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ও মডিউলার কোর্স
ডিজাইন করতে হবে।
৩. ব্যবহারিক মূল্যায়ন পদ্ধতি
প্রকল্প, উপস্থাপনা, কেস স্টাডি ও বাস্তব সমস্যা
সমাধানের মাধ্যমে দক্ষতা যাচাই করতে হবে।
৪. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ
শিক্ষকদের CBE পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত করতে হবে
যাতে তারা দক্ষতা ভিত্তিক শিখন কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেন।
৫. প্রযুক্তির ব্যবহার
AI,
LMS (Learning Management System), এবং ইন্টারেক্টিভ টুলস ব্যবহার করে শিক্ষাকে আরও গতিশীল করা যায়।
বাংলাদেশে দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োগ
বাংলাদেশে
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং নতুন শিক্ষাক্রমে দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষার উপর জোর
দেওয়া হয়েছে।
১. নতুন শিক্ষাক্রমে CBE
২০২৩ সাল
থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে, যেখানে:
- শিখনকালীন মূল্যায়ন
(Continuous
Assessment) গুরুত্ব পাচ্ছে।
- ব্যবহারিক কাজ ও
প্রকল্প ভিত্তিক শিখনকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
২. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় CBE
- কারিগরি শিক্ষা
বোর্ড (BTEB) এবং বিভিন্ন
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে দক্ষতা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
- NVQF (National Technical and
Vocational Qualification Framework) চালু করা হয়েছে।
৩. চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
- চ্যালেঞ্জ: শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা।
- সম্ভাবনা: ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্পের সাথে CBE-এর সমন্বয় করে শিক্ষার মান বৃদ্ধি সম্ভব।
দক্ষতা-ভিত্তিক
শিক্ষা (Competency-Based
Education) আধুনিক
শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন,
যা
শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত করে। এটি শুধু জ্ঞানার্জন নয়, বরং দক্ষতা উন্নয়নের উপর জোর
দেয়,
যা
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সরকার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সম্মিলিত
প্রচেষ্টায় CBE
সফলভাবে
বাস্তবায়ন করা সম্ভব,
যা একটি
দক্ষ ও উদ্ভাবনী প্রজন্ম গড়ে তুলবে।
SPCA English Article: https://spca.education/competency-based-education-cbe/